ইরানের বিশ্বয়কর রাজনৈতিক উত্থান: সাম্রাজ্য থেকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর

ইরানের বিশ্বয়কর রাজনৈতিক উত্থান: সাম্রাজ্য থেকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর

ইরানের ইতিহাস শুরু হয়েছিল পারসিক সাম্রাজ্যের গৌরবময় যুগ থেকে, যা ৬ষ্ঠ শতাব্দী পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীন ইরান ছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য, যেখানে সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ও সামরিক ক্ষমতা বিকাশ লাভ করেছিল। আধুনিক যুগে, ইরান তার অতীতের সাম্রাজ্যবাদী ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।

১৯শ ও ২০শ শতাব্দীর শুরুতে ইরান ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রভাবের মধ্যে আটকে ছিল। পহলভি সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব একটি বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে, যা দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়।

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব

ইরানের আধুনিক রাজনৈতিক উত্থানের মূল স্তম্ভ হলো ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব। রেজা শাহ পহলভির পশ্চিমাপন্থী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি নেতৃত্বে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। খোমেনির ইসলামী মতাদর্শের ভিত্তিতে ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিপ্লব ইরানের আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে।

ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ধর্মীয় নেতা বা “সুপ্রিম লিডার” কর্তৃক পরিচালিত হয়, যার ক্ষমতা কার্যত অসীম। ইরানের সরকার সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় ব্যবস্থায় চললেও সুপ্রিম লিডারের অধীনে এক কেন্দ্রীয় ধর্মীয় নেতৃত্ব সক্রিয়। এই পরিবর্তন ইরানের বিদেশ নীতিরও পুনর্গঠন ঘটায়, যেখানে পশ্চিমাপন্থী নীতি ত্যাগ করে ইসলামী মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা

ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের রাজনৈতিক উত্থানে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধ। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরানকে দুর্বল করতে আক্রমণ চালান। যদিও এই যুদ্ধ ইরানের অনেক ক্ষতি করে, কিন্তু দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে এবং তাদের সামরিক ক্ষমতা গঠন করতে সহায়ক হয়।

এরপর থেকে ইরান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষ করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর শঙ্কার কারণে। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে ইরান নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে এবং এভাবে নিজেদেরকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে উত্থান

ইরানের রাজনৈতিক উত্থান শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নয়, বরং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে তাদের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান অন্যতম প্রধান প্রভাবশালী দেশ। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, এবং ইয়েমেনের মতো দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ইরানের সরাসরি বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ তাদের প্রভাব বাড়িয়েছে। ইরান শিয়া মুসলিম মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সুন্নি আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ইরান বিশেষ করে হিজবুল্লাহ এবং হাউথি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মতো শিয়া সংগঠনগুলোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি বজায় রাখছে।

পারমাণবিক কর্মসূচি: রাজনৈতিক মাইলফলক

ইরানের রাজনৈতিক উত্থানে আরেকটি প্রধান অনুঘটক তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি। ইরান দাবি করে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে, তবে পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। এই কর্মসূচির কারণে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক চরম উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসে, তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার ফলে আবারও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ইরানের রাজনৈতিক উত্থান এখনো সম্পূর্ণ হয়নি এবং ভবিষ্যতে তাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে। তবে ইরানের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক দক্ষতা ভবিষ্যতে দেশটির উত্থানকে অব্যাহত রাখবে বলে ধারণা করা যায়।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে এবং গ্লোবাল শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ইরান আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী কৌশল দেশটির ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করবে।