১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রের ফল হলেও, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনকালে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন, তারা প্রায় সবাই বৃটিশ আমলে মুসলিম লীগের সদস্য বা নেতা ছিলেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা ফজলুল হক মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি এবং সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জনমত গঠনে প্রচার চালান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাংলার মুসলিম লীগের নেতা এবং ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, জিন্নাহর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করা হয়, যা পরিণত হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। সোহরাওয়ার্দী এবং মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান এই কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রায় সব মুসলিম আসনে জয়ী হলেও, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়। মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে বাংলার জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে। এতো অল্প সময়ে এমন বিপরীতমুখী পরিবর্তন ইতিহাসে বিরল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ সাম্রাজ্য বুঝে গিয়েছিল যে, ভারতকে উপনিবেশ হিসেবে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাই তারা ভারতকে বিভক্ত করে যায়। সেই সময়ে মুসলমানরা অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, এবং ব্যবসায়িকভাবে পিছিয়ে ছিল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের আশার সঞ্চার করে, যে তারা জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্তি পাবে, ব্যবসায় উন্নতি করবে, এবং চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে মোহভঙ্গ ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে কলোনির মতোই শাসন করতে শুরু করে, যা বাংলার জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলার ভাষা, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতির উপর আক্রমণ চালায়। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়, যার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। এভাবেই ক্রমান্বয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের জন্ম হয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধাপে ধাপে বিকাশ হয়। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের নির্বাচন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং সবশেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ—এই ধারাবাহিক সংগ্রামই ছিল আমাদের স্বাধীনতার পথচলা।